ফরহাদ মজহারের দর্শনতত্ত্ব
–ড. মোঃ কামরুজ্জামান।
মেহেরপুর দিগন্ত : ফরহাদ মজহার একজন বাংলাদেশি কবি ও লেখক। তিনি একজন প্রথিতযশা গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দার্শনিক। বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী, ঔষধশাস্ত্রবিদ এবং পরিবেশবাদী হিসেবেও দেশে তার খ্যাতি রয়েছে।
ফরহাদ মজহার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে ঔষধশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউ স্কুল ফর সোশাল রিসার্চ থেকে অর্থশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করেন। ঔষধশাস্ত্রবিদ জনাব মজহার সাংবাদিকতা পেশায়ও কাজ করেছেন কিছুদিন । চিন্তা নামক একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কিছুদিন ধরে।
চিরদিনই মূল স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটেছেন ফরহাদ মজহার। বিশ্ববিদ্যাল জীবনে তিনি যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সাথে। পরবর্তীতে তিনি ভারতীয় নকশাল আন্দোলনে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। এ আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে যুক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের সর্বহারা পার্টিতে। এরপর আমেরিকাতে প্রায় এক দশক স্বেচ্ছায় নির্বাসনে ছিলেন । দেশে ফিরে এসে তিনি সক্রিয় হন মাওবাদী আন্দোলনে । বিভক্ত এ আন্দোলনকে একিভূত করতে গঠন করেছিলেন ‘ঐক্য প্রক্রিয়া’। কিন্তু বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রীদের ঐক্য স্বপ্নই থেকে গেছে। জনগণের সাড়া না পেয়ে এ সময় অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের মতোই ফরহাদ মজহারের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের মোহভঙ্গ ঘটে।
ফরহাদ মজহার সবসময়ই ছিলেন একরোখা আর নিজ যুক্তিতে অটল। তিনি এখন কোনো দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত নন। তথাপিও রাজনীতির আঙ্গিনাতেই যেনো তার পদচারণা। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে আনসার বিদ্রোহে সমর্থন দেন ফরহাদ মজহার। বিদ্রোহের সমর্থনে তার নিজ পত্রিকা ‘পাক্ষিক চিন্তা’য় একটি কলাম লিখে তিনি কারাবন্দী হন। আন্তর্জাতিক চাপে ফরহাদ মজহারকে দ্রুত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সরকার। ফরহাদ মজহার বিএনপি’র ডান ঘেঁষা রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন এককালে। আর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতে ইসলামীর আঁতাতকে কচুকাঁটা করেছেন তাঁর কলামগুলোতে। ফরহাদ মজহার অনেক ঘাটের জল ঘোলা করেছেন। তিনি এক সময় ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন বলেও অনেকে মনে করেন।
সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন মুল্লুকে তিনি এক দশক পার করেছেন । তারপরও ফরহাদ মজহার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
মাদ্রাসার এতিম ছাত্রদের’ নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন মার্কিন আগ্রাসন প্রতিরোধ করার। তিনি সম্পদে নারীর সমঅধিকার দানকে উস্কানীমূলক বলে প্রচার করেছিলেন।
ফরহাদ মজহার সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতার মাধ্যমে ইসলামী মতবাদকে উৎসাহিত করেছেন। তার ক্ষুরধার লেখনীতে ইসলামী মতবাদের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলাদেশী ধর্মনিরপেক্ষবাদীদেরকে বুশ-ব্রাউনের এজেণ্ট বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ফরহাদ মজহারের ভাষায়, ‘এদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা আর গলায় সাপকে ফুলের মালা বলা একই কথা’। তার মতে, বাংলাদেশের হাজার বছরের সাংস্কৃতিক চেহারা, আর্থ-সামাজিক আচার, আর ধর্মীয় চেতনা পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা হয়নি। ফরহাদ মজহার যাদেরকে সাপ বলে অভিহিত করেছিলেন, তারাই তাঁর এককালের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ বিনির্মানের সহযোদ্ধা ছিলেন। ইউরোপের চার্চ থেকে পৃথক হওয়া রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে ফরহাদ মজহার ঐতিহাসিক বিবেচনায় সমর্থন করেছিলেন। আবার বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লবের অনিবার্যতাকেও তিনি অবশ্যম্ভাবী মনে করেছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কিছুটা ঘুরিয়ে ফ্যাসিবাদ বলে অভিহিত করেন। তিনি মনে করতেন, বাংলাদেশে ইসলামের যুদ্ধটা এই ফ্যাসিবাদ আর পরাশক্তির সমর্থকদের সাথেই ঘটবে।
তাঁর সামগ্রিক জীবনের এই নানা বিবর্তন অনেকটা স্ববিরোধীতায় ভরা। তার এই ভাব দর্শনের নানা পরিবর্তন নিয়ে মানুষের মনে অনেক কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি তার একটি বক্তব্য আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
তিনি এই ভিডীওতে ইসলামের বেশ কিছু হুকুম আহকামের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মাযার ভাঙা ঠিক না। মাযারে যেয়ারাত ও গান বাজনা করা জায়েয। তিনি আরো বলেছেন, দাঊদ (আ) গান বাজনা করতেন। আগের জগতে মূর্তি বানানো হতো প্রভূর সমকক্ষ ভেবে কিন্তু এখন সেটা নেই। কাজেই এখন মূর্তি বানানো যায়। ফলে যারা এখন মূর্তি ও ভাস্কর্য বানায় তাদেরকে কাফের বলা যায় না।
তিনি বলেছেন, “কোরআন শুধু হেদায়েতের গ্রন্থ। এটা নির্দেশ দাতা বা আইন প্রণেতা নয়, বরং পরামর্শদাতা। আমি আইন, আমার কথাই শেষ কথা, কোরআন এটা বলেনা। কাজেই হেদায়াত ছাড়া কোরআন যারা পড়ে তারা আদৌ মুসলিম কিনা এ ব্যাপারে তিনি সন্দেহ পোষণ করেছেন।
তিনি এখানে তার কিছু দর্শন পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “কোরআন দলীল না। বরং ওহির আকারে তাকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। যাকে বুঝতে বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। বিবেকের কথা নিতে হবে। যুক্তির প্রয়োগ করতে হবে। আর কোরআনকে দলীল বলা হলে ছোটো করা হবে। ফলে যে এটাকে ছোটো করবে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।
তার মতো খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীর এই কথাগুলো আমার কাছে খুব দুর্বল ও অসাড় মনে হয়েছে। সাধারণের কাছেও এটা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে তার কথাগুলো বিভ্রান্তিতে ভরপুর । তার কথাগুলো বিভ্রান্তগ্রুপেরই প্রতিধ্বনি বলে মনে হচ্ছে। কোরআনের যেকোনো সাধারণ পাঠক মাত্রই জানেন যে এটি একটি দালীলীক গ্রন্থ। কোরআন নিজকে দলীল বলে ঘোষণা করেছে। সূরাহ নিসার ১৭৪ নং আয়াতে কোরআনকে বুরহান বলা হয়েছে। “বুরহান অর্থ প্রমান যা অকাট্য হয়ে থাকে এবং পূর্ণ বাস্তব জ্ঞান দান করে।
তিনি রাস্ট্রের ইসলামী তকমার বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, রাস্ট্র ইসলামী হতে পারেনা। ইসলামী হয় মানুষ। এইজন্য রাস্ট্রের কোনো ধর্ম হয়না। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন যা আসলেই ভুলে ভরা। তিনি বলেছেন, ইসলামে রাস্ট্র নেই, আছে সমাজ। আধুনিক রাস্ট্র বলতে জুডিও খৃস্টান চিন্তাধারার ফল। এর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
অথচ কোরআন ও হাদিসের অনেক জায়গায় এ সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামী শাস্ত্রের অনেক স্থানে খিলাফাত শব্দ ব্যবহার হয়েছে। হাদীসে “ইমামুন আদিলুন” পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। আল-কোরআনে সরাসরি “আল-মুলক” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে কোরআন ও হাদীস দিয়ে অর্ধেক পৃথিবী শাসিত হয়েছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবগুলো দেশই ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী যেকোনো নেতাদের তুলনায় তারা অধিক শান্তিপ্রিয় বলে বিশ্বে প্রতীয়মান হচ্ছে। মহানবী (স), সাহাবায়ে কেরাম (রা) ও পরবর্তী শাসকগন এই ধর্ম দিয়েই পৃথিবীর শাসনভার পরিচালনা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সোলায়মান (আ:) ও দাউদ (আ:) আল্লাহ প্রদত্ত ওহী দিয়েই গোটা দুনিয়া পরিচালনা করেছিলেন।
সুতরাং রাষ্ট্রের ধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবেই। বিশ্বের ৬০টির অধিক রাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ রয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ দেশে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রয়েছে। এ দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু হঠাৎ করে ফরহাদ মজহারের এ বক্তব্য জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় সকল রাষ্ট্রেরই ধর্ম রয়েছে। আলজেরিয়া, বাহরাইন, ব্রুনাই, কমোরস, মিসর, ইরাক, জর্ডান, কুয়েত, লিবিয়া, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মরক্কো, ওমান, কাতার, সোমালিয়া ও তিউনিসিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। অর্থাৎ এসব দেশে ইসলাম ধর্ম ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ হিসেবে স্বীকৃত।
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম ছাড়াও অন্য কয়েকটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই খ্রিস্টধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। পোল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি ও স্পেনে প্রধান ধর্ম রোমান ক্যাথলিক। ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে লুথেরান ধর্ম প্রাধান্য পায়। আর্জেন্টিনা, কোস্টারিকা, মাল্টা, মোনাকো ও সুইজারল্যান্ডের কিছু ক্যান্টন ও ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রধর্ম রোমান ক্যাথলিক। সাইপ্রাস ও গ্রিসে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অ্যান্ডোরা, ডোমিনিকান রিপাবলিক, এল সালভেদর, প্যারাগুয়ে, পেরু, পর্তুগাল ও শ্লোভাকিয়ার সংবিধানে ক্যাথলিক ধর্মকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর্মেনিয়ায় অ্যাপোস্টলিক চার্চ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। ইহুদি ধর্মই ইসরাইলের একমাত্র চালিকাশক্তি।
যদি রাষ্ট্রের ভাষা থাকতে পারে, তাহলে ধর্ম থাকতে পারবে না কেন? যদি রাষ্ট্রের ধর্ম না হতে পারে তাহলে রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ, মতবাদ বা দর্শন থাকে কী করে?
রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক হতে পারে তাহলে ইসলামী হতে সমস্যা কোথায়? ফরহাদ মজহারকে নিয়ে আমার স্টাডি হলো তিনি একজন রহস্যময় পুরুষ। শুভ্র দাড়ি আর লম্বা চুলের অধিকারি এ লোকটি সেক্যুলার বাম বিপ্লবের আধ্যাত্মিক নেতা! যার নিজস্ব কোন রাজনৈতিক দল নেই। তিনি বিদেশি শত্রুর বিশ্বস্ত এক অনুচর। যে কারণে তিনি রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বললেও অন্য কোনো রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। সুন্নতি লেবাসের আড়ালে ব্যক্তিটি ভ্রান্ত লালন দর্শনকে প্রমোট করে চলেছেন।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Email: dr.knzaman@gmail.com
‘
আপনার মতামত লিখুন :