একটি ইসলামী দলের কর্মীদের যোগ্যতা -ড. মোঃ কামরুজ্জামান


mdiganta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৯, ২০২৪, ১:১৭ অপরাহ্ন /
একটি ইসলামী দলের কর্মীদের যোগ্যতা -ড. মোঃ কামরুজ্জামান

একটি ইসলামী দলের কর্মীদের যোগ্যতা
ড. মোঃ কামরুজ্জামান

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে ইসলামী রাজনীতিতে দুটি দল বেশি সক্রিয়। একটি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী আরেকটি হলো ইসলামী আন্দোলন, চরমোনাই। আগস্ট বিপ্লবের পর এ দুটি সংগঠন নিয়ে দেশের ইসলামী জনতার একটি আশা সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশা করছেন এ দুটি সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। ইসলামী রাজনীতিতে সক্রিয় ছোটো ছোটো আরো ডজন খানেক দল রয়েছে। দেশবাসী আশা করছে তাদেরকেও এ ঐক্যে শামিল করা হোক! দেশে যেহেতু এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেই। তাই দেশে এখন সবচেয়ে বড়ো সংগঠন হলো বিএনপি। তাদের ভোটার সংখ্যা দেশে ৩৫ পার্সেন্ট। মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকলেও ভোটের মাঠে তাদের কোনো প্রভাব পড়বেনা বলে আমার ধারণা। দেশে তাদের ভোটার সংখ্যা ৩০% বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। দেশের অনেকে মনে করেন, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে বিএনপির ক্ষমতায় আসাটা অনেকটা নিশ্চিত। ইসলামপ্রিয় জনতা মনে করেন, ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলে তাদের ক্ষমতায় আসাটাও অসম্ভব নয়। কারণ বিপ্লবের পর বিএনপি দেশের অনেক জায়গাতে আওয়ামী লীগের উপর নির্যাতন করেছে। তারা দেশে লুটপাট ও চাঁদাবাজি করেছে। টাকার বিনিময়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী বিএনপির শেল্টার পেয়েছে। কিন্তু ইসলামপন্থীরা বিশেষ করে জামায়াত সেটা করে নাই। জামায়াতে ইসলামী নিঃস্বার্থে দেশের অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দিয়েছে। এ কারণে বিএনপি’র চেয়ে জামায়াতের প্রতি তাদের আস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাই অনেকে মনে করছেন নির্বাচন হলে আওয়ামী ভোটাররা বিএনপিকে ভোট দিবে না, ভোট দেবে জামায়াতে ইসলামীকে। এ কারণে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন মনে করছে, তারা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তাহলে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। তবে আমি তা মনে করি না। কারণ একটি শোডাউন অথবা একটি সমাবেশ দিয়ে কোনো দলকে বিচার করা যায় না। ভোটের রাজনীতি আর একটি বড়ো সমাবেশ এক জিনিস নয়। ভোটের রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলো একেবারেই শিশু। এছাড়া জামায়াত ব্যতীত অন্যদের রাজনীতির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। জামায়াত ১৯৪১ সাল থেকে রাজনীতি করলেও দেশে অন্যান্য ইসলামী দল রাজনীতি শুরু করেছে নব্বইয়ের দশক থেকে। এছাড়া দেশে ইসলামপন্থীদের ভোটের অবস্থা মোটেই ভালো না। জামায়াতে ইসলামির ভোটার ১০ থেকে ১৫% এর বেশি হবে না। আর চরমোনাই এর ভোটার সংখ্যা এক পারসেন্ট এর বেশি হবে না। প্রচলিত রাজনীতিতে রাজনীতিকরা রাজনৈতিকভাবে অনেক প্রাজ্ঞ ও অভিজ্ঞ। কিন্তু ইসলামী দলের অধিকাংশ নেতা রাজনীতিতে কাঁচা, অপরিপক্ক ও অনভিজ্ঞ।
জামায়াতে ইসলামী গোছানো ও সুশৃঙ্খল একটি সংগঠন হলেও অন্যান্য ইসলামী দল ততোটা গোছানো নয়। দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের প্রায় প্রত্যেকটিতে জামায়াতের সাংগঠনিক কমিটি থাকলেও অন্যদের তা নেই। তাদের সর্বোচ্চ থানা পর্যায়ে সাংগঠনিক কমিটি আছে। জামায়াতে ইসলামীর ইসলামী ছাত্র সংগঠনের নাম ইসলামী ছাত্রশিবির। সারাদেশে তাদেরও সাংগঠনিক ভিত্তি আছে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের অবস্থান অনেক মজবুত। কিন্তু অন্যান্য অধিকাংশ ইসলামী সংগঠনের কার্যক্রম শুধুমাত্র কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। প্রচলিত সংগঠনের নেতাকর্মীরা যুগের চাহিদার দাবি মোতাবেক নানাবিধ জ্ঞানে সমৃদ্ধ। তারা কলা, বিজ্ঞান, ব্যবসায়সহ বৈচিত্র জ্ঞানে পারদর্শী। তাদের অনুসারি কর্মীরা বঙ্গভবন, গণভবন, সচিবালয় থেকে শুরু করে দেশের সকল সেক্টর পরিচালনায় অভিজ্ঞ। কিন্তু ইসলামী দলের নেতাকর্মীরা কোরআন-হাদিসের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হলেও তাদের কর্মের পরিসীমা মসজিদ এবং মাদ্রাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেশের কোনো সেক্টরেই তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাদের মাঝে আধুনিক চিন্তা, আধুনিক জ্ঞান ও শিল্পসঞ্জাতের চরম অভাব পরিলক্ষিত হয়। মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার থাকার উপর একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান নির্ভর করে না। এটি নির্ভর করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দলটি কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারলো তার উপর।
আমরা জানি, বর্তমানে পৃথিবীতে নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ইহুদি জাতি। অথচ তারা সংখ্যায় খুবই অল্প। ৫০০ জন মানুষের ভিতরে ইহুদি সংখ্যা মাত্র একজন। এই একজন মানুষ ৪৯৯ জন মানুষকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। পৃথিবীতে মোট মানুষের সংখ্যা ৮০০ কোটি। ইহুদিদের সংখ্যা এক থেকে দুই কোটি বলা যেতে পারে। এই স্বল্প সংখ্যক মানুষ ৮০০ কোটি মানুষকে পরিচালনা করছে। পৃথিবীর শতকরা আশি ভাগ ব্যবসা বাণিজ্য তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। ইহুদিরা আধুনিক প্রযুক্তিসহ কোরআন-হাদিসের ব্যাপক জ্ঞান রাখে। তারা আরবি, হিব্রু ও ইংরেজি ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী। বিপরীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের উচ্চ গবেষণায় মুসলিম বিশ্ব একেবারেই পিছিয়ে। বিশেষত বাংলাদেশের আলেমগণ কোরআন- হাদিস জানলেও প্রযুক্তিতে তারা অনেকটা মূর্খ বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রযুক্তির জ্ঞানকে আমাদের দেশের আলেমগণ নিষ্প্রয়োজন মনে করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এটাকে হারাম ঘোষণা দিয়ে থাকেন। মাদ্রাসাগুলোতে সম্প্রতি বাংলা, ইংরেজি চালু হলেও সেটা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। দেশের অনেক আলেম কওমি মাদ্রাসার বাইরে এসে অন্য যে কোনো লেখাপড়াকে হারাম মনে করেন।
দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০০ এর উপরে। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় অর্ধ কোটি। দেশের সরকারি কলেজের সংখ্যা ৭০০ এর উপরে। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ। দেশে বেসরকারি কলেজ ও স্কুল সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক। আর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। সব মিলিয়ে দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। দেশে ২৫ বছরের তারুণ্যের সংখ্যা ৬ কোটির মতো। এ বৃহৎ তরুণসমাজের সাথে ইসলামপন্থীদের খুব একটা সম্পৃক্ততা নেই। দেশে প্রায় ১২ কোটি ভোটার রয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে সর্বমোট বাসগৃহের সংখ্যা ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার ৯৫১ টি। এর মধ্যে পল্লী এলাকায় ২ কোটি ৭৮ লাখ ১১ হাজার ৬৬৭টি এবং শহর এলাকায় ৮১ লাখ ৭৯ হাজার ২৮৪টি। তৃণমূল এসব মানুষ এবং বাড়ির সাথেও ইসলামপন্থীদের কাঙ্খিত কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের উপরই অনেকাংশে কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়া নির্ভর করে।
ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে। তাই তাদের উচিত হলো, হল দখলের চিন্তা বাদ দিয়ে এই বিশাল ছাত্রজনতার মন জয় করা। তাদের প্রত্যেকের কাছে ইসলামের আধুনিক উপযোগিতা পেশ করা। কারণ তাদের অধিকাংশের কাছে ইসলামী আদর্শের কোনো বাস্তবসম্মত ধারণা নেই। তারা বাউল, লালন ও জেমসের দর্শনে প্রভাবিত। যুগসন্ধিক্ষণের চাহিদা মেটাতে ইসলামের উপযোগিতা তাদের সামনে তুলে ধরার এখনই সময়। দীর্ঘ ষোলো বছর পরে ইসলামপন্থীরা একটি সুন্দর পরিবেশ পেয়েছে। এ পরিবেশটা তাদের কাজে লাগানো উচিত। উল্লেখিত প্রত্যেকটি ঘর এবং মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর এখনই সময়। কারণ এ সময়টি যেকোনো সময় হারিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। সুতরাং এ পরিবেশটি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলামপন্থীদের জন্য একটি বড় নেয়ামত। এ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা দরকার। ঘনো ঘনো এবং বড়ো বড়ো সমাবেশ ও বড়ো বড়ো শোডাউন দলের জন্য খুব বেনিফিট বয়ে আনে না। এটির মাধ্যমে বিদেশি মিডিয়াগুলো আপনাদেরকে আকাশে উঠাতে চাইবে। আপনাদের প্রচার অভিযান ফলাও করে প্রচার করবে। কিন্তু ভোটের মাঠে আপনাদেরকে মাটিতে নামিয়ে ছাড়বে। কিন্তু আপনাদের যদি জনসম্পৃক্ততা থাকে তাহলে কেউ কিছু করতে পারবে না। কোনো শক্তি আপনাদেরকে দুর্বল করতে পারবে না। এ কারণে ইসলামপন্থীদের উচিত দেশের প্রতিটি ঘরে এবং প্রতিটি মানুষের কাছে ইসলামের সামগ্রিক সৌন্দর্য তুলে ধরা।
ইসলামপন্থীদের মনে রাখা উচিত, আমেরিকা, ভারত এবং চীন আপনাদেরকে কখনো ক্ষমতায় আনবে না। ক্ষমতায় আসতেও দেবে না। এমনকি বিরোধী দলের আসনটিও অলংকৃত করতে দেবেনা। এ মুহূর্তে আপনাদের একমাত্র অবলম্বন দেশের ১৮ কোটি মানুষ। এই ১৮ কোটি মানুষকে আপনারা বন্ধু বানান। আবেগ কন্ট্রোল করুন! হিংসা, বিদ্বেষ ও উদ্দেশ্যমূলক ফতোয়াবাজি বন্ধ করুন! ইসলামের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ইসলামের সাম্যনীতি প্রচার করুন! যুগ সন্ধিক্ষণের চাহিদা মতো নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলুন! আপনারা নিজেদের প্রমাণ করুন যে আপনারা নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক এবং মানবদরদি। এটা প্রমাণ করতে পারলে জনতাই আপনাদেরকে ক্ষমতার মসনদে আসীন করবে। তখন কোনো ষড়যন্ত্র এবং রক্তচক্ষু আপনাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

Email: dr.knzaman@gmail.com