সাহাজুল সাজু : যে ঘরটিতে স্বামীর সাথে সত্তর বছর কাটিয়েছি। জন্ম দিয়েছি চৌদ্দটি সন্তান। সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই সারাটি জীবন। যদিও স্বামী গত মারা গেছেন ত্রিশ বছর। এখনও মনে হয় উনি এঘরেই আছেন। এমন নানা রকম স্মৃতি বিজড়িত অভিমত ব্যক্ত করেন একশত চৌদ্দ বছর বয়সি জাহেরা বেগম। জাহেরা বেগম মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার ধানখােলা ইউনিয়নের কচুইখালি গ্রামের মৃত আতর আলীর স্ত্রী। তিনিই ওই গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও রান্না-বান্নাসহ সংসারের সব কাজই করেন স্বাভাবিক ভাবে। আধুনিকতায় মাটির দেয়াল ও ঘড়ের চাউনির ঘর বিলুপ্তি হলেও এখনও বিভিন্ন এলাকার মানুষ দেখতে আসেন জাহেরা বেগমের মাটির দেয়াল আর আট চালা খড়ের ঘরটি।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্বামীর ঘরে আসেন জাহেরা বেগম। তখন স্বামীর যশ ছিল, খ্যাতি ছিল। সে সময় স্বামী তৈরী করেছিল ৮ চালা বিশিষ্ট একটি মাটির ঘর। সে ঘরেই শুরু হয় তাদের দাম্পত্য জীবন। সংসার জীবনে মা হয় ১৪টি সন্তানের। এদের মধ্যে ৮ ছেলে ও ৫ মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে সবাই আছেন স্বামীর সংসারে। ছেলেরা সকলেই সাবলম্বি। তাদের রয়েছে একেক জনের পাঁকা ঘর। সব ছেলেরা বৃদ্ধা মা জাহেরা বেগমকে তাদের ঘরে থাকতে বল্লেও পাঁকা ঘরে থাকতে নারাজ বৃদ্ধা জাহেরা বেগম । স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে স্বামীর হাতের নির্মিত আট চালা চিলিকোঠা ঘরেই থাকতে চান তিনি।
বৃদ্ধা জাহেরা বেগম বলেন,ছেলেদের সবারই পাঁকা ঘর হয়েছে। আমাকে তারা তাদের পাকা ঘরে রাখতে চাই। আমি সেখানে থাকতে চাইনা। স্বামীর তৈরী ঘরটাকেই আমার স্বর্গ মনে হয়। স্বামীর সাথে সংসারের অনেক স্মৃতিই জড়িয়ে আছে মাটির ঘরে। ঘরে ঢুকলেই মনে পড়ে স্বামী সন্তানের হাজারও স্মৃতি। বয়স হলেও এখনও সংসারের কাজ করতে ভাল লাগে। এখনও সাভাবিক ভাবেই চলতে পারি। যতােদিন বেঁচে আছি এখানেই থাকতে চাই।
তিরি আরও বলেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারে সন্তানদের বাঁচাতে এবং নিজের জীবন বাাঁতে ভারতে পালিয়ে ছিলাম। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে আবারও ফিরে আসি আপন ঘরে। ১৪ সন্তানের মধ্যে ৪ ছেলে মারা গেছে। এখনও বেঁচে আছে ১০ ছেলে মেয়ে।
জাহেরা বেগমের বড় ছেলে নুর ইসলাম বলেন, আমার মায়ের অনেক বয়স হয়েছে। আমরা চেষ্টা করি তাকে আমাদের সংসারে রাখতে। কিন্তু কোন ভাবেই তাকে বোঝাতে পারিনা। সে মাটির ঘরেই থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরাও আমার বৃদ্ধা মায়ের যত্ন নিয়ে থাকি। মা বলে পাঁকা ঘরে শীতের সময় বেশি শীত ,আর গরম কালে বেশি গরম। মাটির ঘর তার থেকে অনেকটাই ব্যতিক্রম।
ছোট ছেলে তোফাজ্জল হোসেন বলেন,মাকে বুঝিয়ে যখন মাটির ঘর থেকে সরাতে পারিনি, তখন সে ঘরের পাশেই আমি পাঁকা ঘর নির্মাণ করেছি। যাতে আপদে বিপদে আমিও মায়ের পাশে থাকতে পারি। তিনি বলেন, আশপাশের গ্রামে আর এতােবড় মাটির ঘর নেই। অনেক মানুষই আমাদের মাটির ঘরটি এখনও দেখতে আসে। ঘর দেখতে এসে অনেকেই আবেগ আপ্লুত হন।
ঘর দেখতে আসা গাংনী শহরের এসিদ্দিকী শাহিন জানান, একসময় জীবন-যাপনের একমাত্র বাসস্থান মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি। এখন আর চোখে পড়েনা। তাই বুদ্ধা জাহেরার মাটির ঘরটি দেখতে এসেছি। ব্দ্ধৃা বয়সেও মাটির ঘরটি অনেক যত্ন করে রাখেন জাহেরা বেগম।
স্থানীয় ধানখােলা ইউপি সদস্য খোকন মিয়া বলেন,খুব বেশি দিনের কথা নয়,যেখানে প্রতিটি গ্রামেই চোখে পড়তো প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাটির বাড়ি। অনেকেই মাটির দেয়াল আর খড়ের ঘরকে আরও দৃষ্টি নন্দন আর পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী আট চালা ঘর তৈরী করে বসবাস করতেন। সে ঘরকে আমরা চিলিকোঠা বলে থাকি। ইদানিং সেসব ঘর আর চোখে পড়েনা। জাহেরা বেগম তার নিপুন হাতের ছোয়ায় আজও মাটির ঘরটিকে সুন্দর করে রেখেছেন। তাছাড়া যারা মাটির তৈরী ঘর নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিল। সেসব কারিগররাও তাদের পেশা পরিবর্তন করেছেন। যার ফলে মাটির ঘর আর কেউ নির্মাণ করছেন না।
প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করা পিএসকেএস এর নির্বাহী পরিচালক মুহাঃ মোশাররফ হোসেন জানান, এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু তুলনামুলক অনেক কম। এসময় শতবর্ষি বৃদ্ধা জাহেরা বেগম এখনও স্বাভাবিক খাবে চলাফেরা করেন। এটি অনেক দুরহ ব্যাপার। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যাবতীয় সহযোগীতা করবো।
ধানখোলা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার ইউনিয়নের কচুইখালি গ্রামের জাহেরা বেগমকে চিনি। তার বয়স প্রায় ১১৪ বছর। তিনি জন্ম দিয়েছেন ১৪টি সন্তান। আশপাশের গ্রামের তিনিই একমাত্র বয়স্ক নারী। আমরাও চেষ্টা করেছি তাকে ‘‘জমি আছে ঘর নাই ’’ সরকারি প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি নিতে চাননি। স্বামীর তৈরী মাটির ঘরেই তিনি বাকি জীবন কাঁটাতে চান। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরণের সরকারি সুবিধা দেয়া হয় বৃদ্ধা জাহেরা বেগমকে।
আপনার মতামত লিখুন :